হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা

হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা


ভূমিকা :

হলি আর্টিজান
১ জুলাই ২০১৬, স্থানীয় সময় রাত ০৯:২০ মিনিটে,নয়জন হামলাকারী ঢাকার গুলশান এলাকায় অবস্থিত হলি আর্টিসান বেকারিতেগুলিবর্ষণ করে। হামলাকারীরা বোমা নিক্ষেপ ও কয়েক ডজন মানুষকে জিম্মি করে এবং পুলিশের সঙ্গে তাদের বোমাবর্ষণের ফলে অন্তত চার পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হয়। প্রত্যক্ষদর্শী একজন জানায় হামলার সময় তারা "আল্লাহু আকবার" (আল্লাহ সর্বশক্তিমান) ধ্বনি উচ্চারণ করে গুলি ছুড়ে ও বোমা ফাটায়।এই ঘটনায় মোট আটাশ জন মানুষ নিহত হয়, যাদের মধ্যে সতের জন বিদেশী, দুই জন পুলিশ কর্মকর্তা এবং ছয় জন বন্দুকধারী। পরবর্তীতে বন্দুকধারীদের এক জনকে বন্দী করা হয় এবং ১৩ জন জিম্মিকে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীপুলিশর‌্যাব এবং যৌথবাহিনী কর্তৃক মুক্ত করা হয়।

পটভূমি

২০১৩ সাল থেকে, বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, ব্লগার এবং ধর্মনিরপেক্ষদের উপর হামলা বাড়তে থাকে।[সেপ্টেম্বর ২০১৫ সাল থেকে, এদেশে এই ধরণের ৩০টি আক্রমণের ঘটনা ঘটে; আইএসআইএস (যা ইসলামিক স্টেট অব ইরাক এন্ড দ্য লেভান্টইসলামিক স্টেট অব ইরাক এন্ড আল-শাম বা দায়েশ নামেও পরিচিত) যার মধ্যে ২১টির দায় স্বীকার করে।গুলশান ঢাকার একটি বিত্তশালী এলাকা এবং এখানে অনেক বিদেশী দূতাবাস অবস্থিত।


আক্রমণ :


আক্রমণের সময় 

আক্রমণ স্থানীয় সময় ৯টা ২০ মিনিটের দিকে শুরু হয়। অন্তত সাতজন হামলাকারী রেস্টুরেন্টে বোমা, বন্দুকসহ প্রবেশ করে এবং একজন আক্রমণকারীর হাতে একটি তলোয়ার ছিল। ঢুকার পর রেস্টুরেন্টে জিম্মি করার আগে গুলি ছুড়তে থাকে ও বোমা ফাটায়, জিম্মিদের বেশীরভাগ ছিল বিদেশী। পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে পুলিশের সাথে তাঁদের গোলাগুলি হয়, এতে দুই জন পুলিশ নিহত হয় ও আরো অনেক আহত হয়। পরে পুলিশ রেস্টুরেন্টে প্রায় এলাকা ঘেরাও করে রাখে এবং একটি উদ্ধার অভিযানের পরিকল্পনা করে। এ সময় পুলিশ মাইকে বারবার জিম্মিদের ছেড়ে দিয়ে জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানালে জঙ্গিরা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে তিনটি শর্ত দেয়:

  • ডেমরা থেকে আটক জেএমবি নেতা খালেদ সাইফুল্লাহকে মুক্তি দিতে হবে।
  • তাদেরকে নিরাপদে বের হয়ে যেতে দিতে হবে।
  • ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তাদের এই অভিযান- স্বীকৃতি দিতে হবে।

রেস্টুরেন্টে ভিতর থেকে ছবি টুইটারে আইএসআইএল-পন্থী অ্যাকাউন্টগুলি থেকে প্রচার হয় এবং এতে কয়েকটি লাশ ও রক্তের দাগ মেঝের উপর পড়ে থাকতে দেখা যায়।



উদ্ধার অভিযান :

জঙ্গিদের আটক 

সরকার প্রধানের নির্দেশে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী 'অপারেশন থান্ডারবোল্ট' পরিচালনা করে। ৬ জুলাই শুক্রবার রাত থেকে সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে অবস্থানরত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যদের কাছ থেকে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, র‌্যাবসহ যৌথভাবে অপারেশন থান্ডারবোল্ট পরিচালনা করা হয়। সেনাবাহিনীর প্যারাকমান্ডোর নেতৃত্বে ঘটনা শুরুর পরদিন, শনিবার, সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে অপারেশন শুরু করে ১২-১৩ মিনিটে ঘটনাস্থলের নিয়ন্ত্রণ নেয়া হয়। পরবর্তীতে সকাল


সাড়ে ৮টার দিকে অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে প্রাথমিকভাবে সন্ত্রাসীদের ব্যবহৃত ৪টি পিস্তল, একটি ফোল্ডেডবাট একে-২২, ৪টি অবিস্ফোরিত আইআইডি, একটি ওয়াকিটকি সেট ও ধারালো দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়।


আহত ও নিহতের সংখ্যা :

নিহত বিদেশিরা
বিশ জন বিদেশী নাগরিক, ছয় জন বন্দুকধারী এবং দুই জন পুলিশ কর্মকর্তা ঘটনার রাতেই নিহত হন। বিদেশীদের ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হয়। যেখানে আরও পঞ্চাশ জন, যাদের বেশিরভাগ পুলিশ সদস্য আহত হন।নিহতদের মধ্যে দুই জন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন, যাদের একজন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ গোয়েন্দা বিভাগের সহকারী কমিশনার, এবং অন্যজন বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। নিহতদের মধ্যে জাপানি ও ইতালীয় নাগরিক ছিল। ১৯ বছর বয়সী এক ভারতীয় নাগরিকও নিহত হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রাথমিকভাবে ঘোষণা করে যে নিহতদের সকলে বিদেশী ছিল, এবং তারা অপরাধীরা যাদের "ধারালো অস্ত্র দ্বারা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল"। দের মধ্যে যারা কুরআন থেকে একটি আয়াত বলতে পেরেছিল শুধুমাত্র সেসকল অ-মুসলিমরা রক্ষা পেয়েছিল। 
নিহতদের মধ্যে সাত জন জাপানি নাগরিক ছিল – পাঁচ জন পুরুষ এবং দুই জন নারী – যাদের জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সির সাথে যুক্ত করা হয়েছে। পরবর্তীতে অপারেশন থান্ডারবোল্টের সময় ছয় সন্ত্রাসী নিহত হয় এবং সন্দেহভাজন একজন সন্ত্রাসীকে আটক করা হয়। এছাড়া এই অভিযানে জিম্মিদশা থেকে তিন বিদেশিসহ ১৩ জনকে মুক্ত করা হয়।





বিদেশি ব্যক্তিবর্গ 

নিহত জিম্মিদের জাতীয়তা
দেশসংখ্যা
 ইতালি০৯
 জাপান০৭
 বাংলাদেশ০৬
 ভারত০১
 মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র০১
সর্বমোট২৪



আইএসআইএস (জঙ্গি) -এর দায় স্বীকার :

ইসলামিক স্টেটের অধিভুক্ত, আমেক সংবাদ সংস্থা, এই হামলার দায় স্বীকার করে এবং ২০ জনকে হত্যার দাবি জানায়। ঘটনার পর তারা একটি ভিডিও প্রকাশ করে এবং হুমকি দেয় এটি সবেমাত্র শুরু ভবিষ্যতে আরো হামলা হবে। 



প্রতিক্রিয়া :

নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা 
  • বাংলাদেশ এই ঘটনায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। তিনি একে ধর্ম ও মানবতার অবমাননা বলে মন্তব্য করেন। তার মতে ইসলাম শান্তির ধর্ম এবং ইসলামের নামে মানুষ হত্যা বন্ধ হওয়া উচিত্। তিনি বলেন “দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে যে কোন মূল্যে আমরা ষড়যন্ত্রকারীদের চক্রান্ত প্রতিহত করব।”[৩৫] রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ এই সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা জানান। এছাড়া তিনি জিম্মি সংকটের অবসানে যৌথ অভিযানে অংশ নেয়া যৌথ বাহিনীর সদস্যদের ধন্যবাদ জানান।
  • ইতালি ইতালির প্রধানমন্ত্রী মাত্তেও রেনসি নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বলেন, “আমাদের মূল্যবোধ ঘৃণা ও সন্ত্রাস থেকে অনেক শক্তিশালী।” এছাড়া তিনি এই ঘটনাকে “বেদনাদায়ক ক্ষতি” বলে মন্তব্য করেন।
  • জাপান জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনযো আবে সন্ত্রাসীদের হাতে জিম্মি জাপানিদের জীবিত উদ্ধারে ঢাকাস্থ দূতাবাসে নির্দেশনা দেয়ার কথা এক সংবাদ সম্মেলনে জানান এবং তিনি এটিকে “দুঃখজনক” হিসেবে আখ্যা দেন। এছাড়া অন্যান্য জাপানি সরকারি কর্মকর্তা ও সংস্থা যাদের মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার, মন্ত্রিসভার মুখ্য সহকারী সচিব কোইচি হাগুইদা, মন্ত্রিসভার সহকারী সচিব ইয়োশিহিদে সুগা, জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) এই ঘটনায় তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করে।
  • ভারত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন “ঢাকায় আক্রমণ আমাদের অনেক কষ্ট দিয়েছে। আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলেছি এবং এ আক্রমণের তীব্র নিন্দা জানাই।
  • মালয়েশিয়া মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক এই ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে সমগ্র বিশ্ব এর মুসলিমদের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে এক হওয়ার কথা বলেন।
  • ভ্যাটিকান সিটি পোপ ফ্রান্সিস হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করেন এবং এই ধরনের হামলাকে “স্রষ্টা ও মানবতার বিরুদ্ধে আঘাত” বলে মন্তব্য করেন।
  • ভুটান ভূটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে ঢাকায় সন্ত্রাসী ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে বলেন “তার দেশ সবসময় বাংলাদেশের পাশে আছে। বাংলাদেশের জনগণ এ ঘটনার মধ্য দিয়ে একটি বার্তা পেয়েছে, সেটি হলো সেদেশের সরকার কোন ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকা-কে প্রশ্রয় দেবে না।





উপসংহার :

গুলশান হামলা বাংলাদেশের ইতিহাসে জঙ্গি হামলার ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। যার সাথে সম্ভবত দেশের কেউ পরিচিত ছিলো না।
তাই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার যে ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে সেসব মানুষকে পুরোপুরি স্বস্তি দিতে আরো কিছু সময় লাগবে বলে প্রতিয়মান হচ্ছে কারণ এক বছর পর এখনো অনেকের মনকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে ভয়াল সেই রাতের অভিজ্ঞতা।

1 comment:

Theme images by rion819. Powered by Blogger.